Home » » শিক্ষা, রাজনীতি ও বাংলাদেশে by অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ

শিক্ষা, রাজনীতি ও বাংলাদেশে by অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ



বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মনীষী ও পণ্ডিত ব্যক্তি শিক্ষার প্রকৃত সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা নিয়ে ভেবেছেন। সক্রেটিস ভাবতেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে সত্যের অনুসন্ধান। ‘প্লেটো ভাবতেন, ‘বাস্তব জ্ঞান ও আধ্যাত্বিক জ্ঞানের সমন্বয়ে আত্মোপলদ্ধির চেতনাই শিক্ষা।’ এরিস্টটল  মনে করতেন, ‘শিক্ষা হল মানুষের দেহ ও মনের সুষম বিকাশ।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন, ‘ব্যক্তি হতে বিশ্বজনীনতায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়াই শিক্ষা।’ উল্লিখিত সবগুলো চিন্তা ও ধারণাই শিক্ষার সংজ্ঞা হিসেবে যুক্তিয্ক্তু। শিক্ষা একাধারে সত্যের অনুসন্ধান, দেহ ও মনের সুষম বিকাশ, ব্যক্তি হতে বিশ্বজনীনতায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়া এবং বাস্তব জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সমন্বয়ে আত্মোপলদ্ধির চেতনা। তাই বর্তমানে উপরোক্ত সব কয়টি সংজ্ঞার আলোকে শিক্ষার সর্বাধুনিক সংজ্ঞাটি হল ‘আচরণের বাঞ্ছিত পরিবর্তনের নামই শিক্ষা।’

সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও পরিবেশকে শিক্ষাঙ্গন বলা হয় যেখানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। শিক্ষাঙ্গন থেকে জ্ঞানার্জন করে শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে জ্ঞানী ও যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়-এসব প্রতিষ্ঠানই শিক্ষাঙ্গনের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র ও আলোকদীপ্ত এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কর্তব্য। অন্যথায়, শিক্ষার্থীর প্রকৃত উদ্দেশ্য বিঘিœত হবে এবং দেশ ও জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার হিসেবে পরিগণিত শিক্ষার্থীরা হবে পথভ্রষ্ট।

রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলতে একটি দেশের মানুষের আচার-ব্যবহারের ভিত্তিতে নির্ধারিত যাবতীয় রাজনৈতিক পদ্ধতি ও কার্যাবলিকে বোঝানো হয়। অন্য কথায়, এটি হলো কোন সমাজের সে সব ঘাত-প্রতিঘাতের ব্যবস্থা যার মাধ্যমে বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাই বলা চলে, ‘রাষ্ট্রের সকল প্রকার রাজনৈতিক কার্যকলাপ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সরকারের অঙ্গ ও সংগঠনসমূহের গঠন ও কার্যাবলি নিয়ে যে সামগ্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তাকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে। ডেভিড ইস্টনের ভাষায়, ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো লক্ষ্য স্থির করার, নিজেকে রূপান্তরিত করার এবং পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করার সূচণামূলক এক ব্যবস্থা।’ গ্যাব্রিয়েল আলমন্ড -এর মতে, ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো একটি বৈধ, শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এবং রূপান্তর সাধনকারী ব্যবস্থা।’ উল্লিখিত সংজ্ঞাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ‘সমাজের মধ্যে বিদ্যমান সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি, পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়কে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে। এটি এমন এক শক্তি যা রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে এবং যার প্রভাব গোটা সমাজকে প্রভাবিত করে।

অধ্যাপক এমাজ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘কোন সমাজের রাজনৈতিক পরিবেশ বলতে আমরা ওই সমাজের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তাদের অনুসারী রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় সংসদের ন্যায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্র্তাদের আচার-আচরণ, পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সাংগঠনিক তৎপরতা, আবহ, বক্তব্য ও বিবৃতির প্রকরণকে বুঝি।’ তাই রাজনৈতিক পরিবেশ হলো রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যবস্থার ধরন ও অংশগ্রহণের মাত্রার সামগ্রিক রূপ। অন্য কথায়, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক জীবন ব্যবস্থার স্তরগুলোর গঠন কাঠামো ও ক্ষমতা চর্চার সমষ্টিগত রূপ ও অবস্থাকে রাজনৈতিক পরিবেশ বলে। যে কোন দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে এক সময় বিরাজমান ছিল এবং দীর্ঘদিন ছিল। ওই সময়ের সেই রাজনীতি মানবতার হত্যাকারী ছিল না, বরং ছিল মানবতার রক্ষা কবচ। গণতন্ত্রের উত্তরণের জন্য এবং অশুভ শক্তির পতনের জন্য এই রাজনৈতিক সংস্কৃৃতি পালন করেছে সহায়ক ভূমিকা। এমনকি, ওই সময়কালের ছাত্র-রাজনীতিও ছিল জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির সহায়ক। ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখতে পাবো অসংখ্য নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য দলিল। পলাশীর যু্েদ্ধর পর থেকে এদেশের নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও চলমান রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি প্রভৃতি ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদাহরণ।

কিন্তু এদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির আদর্শ ও নীতিগত নির্দিষ্ট ও স্থায়ী কোন মান নেই। খেয়াল খুশি, স্বার্থপরতা ও প্রতিহিংসার অন্ধত্বের কারণে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন তো দূরের কথা, আদর্শ ও প্রকৃত শিক্ষার ভিত্তি বিল্প্তুকরণসহ শিক্ষার সব ধরনের কাক্সিক্ষত বিকাশকে বাধাগ্রস্ত ও বিপন্ন করতেও রাজনৈতিক এই অপসংস্কৃতি কুণ্ঠিত হয় না। তাই শিক্ষা বিস্তরণের এই সমৃদ্ধ যুগেও শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শত শত মাইল পিছিয়ে আছে। রাজনৈতিক এই অপসংস্কৃতির করাল ছোবল থেকে আমাদের জাতীয় শিক্ষাকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।

‘রাজনীতি’ শব্দটির ব্যাসবাক্য হলো নীতির রাজা এবং বাংলা ব্যাকরণের রীতি অনুসারে এটি ষষ্ঠি তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ। অতীতে বাস্তবিকই এদেশের রাজনীতি নীতির রাজা হিসেবে দেশ ও জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইংরেজ শাসনামল থেকে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ আমরা দেখতে পাই। ওই সময়কালে ছাত্র-রাজনীতিও ছিল দেশ ও জাতির জন্য ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তর ও নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্র-রাজনীতির ভূমিকা ও অবদান ছিল অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূর প্রসারী কিন্তু সেই দেশপ্রেম মাখা ইতিবাচক রাজনীতির ধারা হঠাৎ করেই উল্টে গেল একানব্বই সাল থেকে এবং ‘রাজনীতি’ শব্দটি ষষ্ঠি তৎপুরুষ সমাস হিসেবে বহাল থাকলেও বদলে গেল ব্যাসবাক্যের স্বরূপ। ‘নীতির রাজা’-র স্থলে এটি ‘রাজার নীতি’ হয়ে দিনের পর দিন মানবতাকে হত্যা করতে লাগলো। ফলে রাজনীতি হয়ে গেলো অপরাজনীতি এবং এর প্রভাবে প্রভাবিত, অভিভূত ও দ্রবীভূত হয়ে ছাত্র-রাজনীতি হয়ে গেলো দেশ ও জাতি বিধ্বংসী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রধান কারখানা। এখন রাজনীতি কিংবা ছাত্র-রাজনীতি-কোনটাই মানবতার মুক্তির জন্য কাজ করে না, সাধ্য-সাধনা চালায় মানবতাকে ধ্বংস ও হত্যা করার জন্য। অতীতে নির্দিষ্ট একটি দলের অধীনে কাজ করলেও ছাত্র সমাজের চিন্তা ও চেতনায় প্রাধান্য পেতো জাতীয় স্বার্থ অর্থাৎ দেশমাতৃকার স্বার্থ অথচ বর্তমানে দলীয় স্বার্থে দেশ ও জাতিকে লজায় ডোবাতেও এক মুহুর্তকাল এরা সংকোচ বোধ করে না। এদের মধ্যে আজ নেই দেশপ্রেম, নেই জাতীয় ঐক্য, নেই মানুষের প্রতি ভালোবাসা। জাতি আজ স্তব্ধ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে ছাত্র-সমাজের উচ্ছৃঙ্খল, অমানবিক ও বেপরোয়া আচরণে।

আমাদেরকে জাতীয় স্বার্থ ও আশা-আকাক্সক্ষার কথা ভেবে প্রথমেই দেশের সর্বস্তরে আদর্শ শিক্ষার বিস্তরণ ঘটাতে হবে এবং এর যথার্থ প্রতিফলনের মাধ্যমে একটি দেশপ্রেমিক শক্তিশালী জাতিসত্তা গড়ে তুলতে হবে। আবেগের পরিবর্তে বেগ, যুক্তির পরিবর্তে প্রযুক্তি, মমতার পরিবর্তে ক্ষমতা, মানবিকতার পরিবর্তে পাশবিকতা-এ ধরনের শিক্ষালাভ এবং শিক্ষা বিস্তারের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা, এ ধরনের শিক্ষার পথ ধরেই ধ্বংসের পথে উত্তরোত্তর এগিয়ে চলছে বিশ্বের সকল দেশ ও জাতি। বিশ্বের সর্বত্র শিক্ষাকে সঠিক ও সমুন্নত রাখতে পারলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিসহ সব ধরনের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ইতিবাচক ও গুণগত পরিবর্তন আসবে।

দেশের বর্তমান বাস্তবতার আলোকে শিক্ষিত সমাজ ও আমজনতার মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ঃ শিক্ষাঙ্গনে আদৌ রাজনীতির প্রয়োজন আছে কিনা। আসলে এ প্রশ্ন এখনকার প্রেক্ষাপটে দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু আমরা যদি অতীত, বর্তমান, জাতীয় স্বার্থ-সবকিছু মিলিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করি, তাহলে ছাত্র-রাজনীতিকে কিংবা শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতিকে একেবারে বাদ দেয়া কিংবা বিদায় করাটা যুক্তিসঙ্গত হবে না। তবে যেভাবেই হোক, দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্যের শক্তিতে এদেশে পুনরায় ইতিবাচক রাজনীতি ও ছাত্র-রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অতীতের মতো নির্দিষ্ট একটি দলের অধীনে পরিচালিত হলেও এটি দলভিত্তিক না হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব ও শৃঙ্খলার নীতিতে দেশ ও জাতীয় স্বার্থভিত্তিক হবে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা এবং দেশ ও জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে সর্বদা প্রস্তুত থাকা- এটাই হবে ছাত্র-রাজনীতির আদর্শ ও চরিত্র। তাহলে ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তর ও নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেভাবে অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছিল, বর্তমানেও জাতীয় উন্নয়নে তা পারবে। এক্ষেত্রে সরকার, বিরোধীদল, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং আমজনতাকে শিক্ষার্থীদেরকে যোগ্য নেতা ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহযোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের সবচেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্য, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের মতো নেতা এদেশে আর উঠে আসছেন না, দেশপ্রেমিক নেতার পরিবর্তে সংকীর্ণমনা ও স্বার্থপর নেতাদের ভিড়ে দেশ ও জাতি আজ হারিয়ে ফেলেছে মানবতা ও গণতন্ত্রের মুক্তির সঠিক ঠিকানা। এজন্য সরকার, বিরোধী দল, জনসাধারণ নির্বিশেষে প্রত্যেককে জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী সকল চিন্তা, চেতনা ও কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করতে হবে।

পরিশেষে বলবো, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি জাতীয় স্বার্থে তখনই অবদান রাখতে সক্ষম হবে যখন এটি দলীয় না হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও জাতীয় হবে। দেশের ছাত্র সমাজকে ক্ষমতামুখী না হয়ে মমতামুখী হতে হবে এবং ‘দ্বেষ-প্রেম’ -এর পরিবর্তে ‘দেশপ্রেম’ এর শক্তিতে উজ্জীবিত হতে হবে। দেশের বিপদ ডেকে আনা নয়, বরং দেশের যে কোন বিপদে ত্রাণকর্তা হিসেবে সবার আগে তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে, একতার সংগীত সর্বপ্রথম তাদেরকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গাইতে হবে। তবেই আমরা পাবো অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং পরনির্ভরতা মুক্ত একটি সুখী ও উন্নত দেশ-স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।

অধ্যক্ষ, মেরন সান কলেজ ; যুগ্ম মহাসচিব, ইউনেস্কো ক্লাবস ফেডারেশন

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Your Link | Your Link | Your Link
Copyright © 2013. অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ রচিত প্রবন্ধ ও নিবন্ধ - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Wiki Template
Proudly powered by Wiki Bangla