Home » » শিক্ষার বিস্তার ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি by অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ

শিক্ষার বিস্তার ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি by অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ



দার্শনিক এরিস্টটল মনে করতেন, ‘শিক্ষা হল মানুষের দেহ ও মনের সুষম বিকাশ। ’ সক্রেটিস মনে করতেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে সত্যের অনুসন্ধান।’ প্লেটো বাস্তব জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সমন্বয়ে আত্মোপলব্ধির চেতনাকেই শিক্ষা বলে মনে করতেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তি হতে বিশ্বজনৗনতায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়াকে শিক্ষা হিসেবে গণ্য করেছেন। বর্তমানে শিক্ষার সব চাইতে আধুনিক সংজ্ঞাটি হল ’আচরণের বাঞ্ছিত পরিবর্তনের নামই শিক্ষা।’ মানব জাতির যুগে যুগে ক্রমোন্নতির মূলে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় উপনীত হওয়ার মূলে উল্লেখিত এই আদর্শ শিক্ষার এবং এর জ্যামিতিক বিস্তরণের ভূমিকা অপরিসীম।
যুগ-যুগান্তরে যে শিক্ষার বিস্তরণের ফলে বর্তমান বিশ্ব সভ্যতা উন্নতিতে ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে গেছে, এই  শিক্ষার সাম্প্রতিক ভারসাম্যহীনতা ও লাগামহীনতার কারণে কুশিক্ষা ও অপশিক্ষা নামের দুটো ভয়ঙ্কর ভাইরাস দীপ্তি ও তৃপ্তিময় আদর্শ শিক্ষা প্রোগ্রামের ভেতর ঢুকে গেছে। বর্তমান শিক্ষায় আচরণের বাঞ্চিত পরিবর্তন সাধিত হয় না , দেহ ও  মনের সাধিত হয়না সুষম বিকাশ। এ শিক্ষায় সত্যের যথার্থ অনুসন্ধান নেই, বাস্তব জ্ঞানের সাথে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সমন্বয় নেই। বর্তমানের  অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তি তার ব্যক্তিসত্তা হতে বিশ্বজনৗনতায় উওীর্ণ হওয়াতো দূরের কথা, আত্মকেন্দ্রিকতা , সহিংসতা , প্রতিহিংসা পরায়ণতা ইত্যাদি দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভোগেন । বর্তমান শিক্ষায় মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে মানবতা বিধ্বংসী রাজনীতি, দুর্নীতি ইত্যাদি। অথচ অনেকে বর্তমানে শিক্ষা ও মানবতা বিধ্বংসী এই রাজনীতি ও দুর্নীতিকে ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ নামে আখ্যায়িতকরণপূর্বক সম্মানিত করে থাকেন।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে এক সময় বিরাজমান ছিল এবং দীর্ঘদিন ছিল। ওই সময়ের সেই রাজনীতি মানবতার হত্যাকারী ছিল না, বরং ছিল মানবতার রক্ষা কবচ। গণতন্ত্রের উত্তরণের জন্য এবং অশুভ শক্তির পতনের জন্য এই রাজনৈতিক সংস্কৃৃতি পালন করেছে সহায়ক ভূমিকা। এমনকি, ওই সময়কালের ছাত্র-রাজনীতিও ছিল জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির সহায়ক। ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখতে পাবো অসংখ্য নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য দলিল। পলাশীর যু্েদ্ধর পর থেকে এদেশের নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও চলমান রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি প্রভৃতি ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদাহরণ।
কিন্তু এদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির আদর্শ ও নীতিগত নির্দিষ্ট ও স্থায়ী কোন মান নেই। খেয়াল খুশি, স্বার্থপরতা ও প্রতিহিংসার অন্ধত্বের কারণে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন তো দূরের কথা, আদর্শ ও প্রকৃত শিক্ষার ভিত্তি বিল্প্তুকরণসহ শিক্ষার সব ধরনের কাক্সিক্ষত বিকাশকে বাধাগ্রস্ত ও বিপন্ন করতেও রাজনৈতিক এই অপসংস্কৃতি কুণ্ঠিত হয় না। তাই শিক্ষা বিস্তরণের এই সমৃদ্ধ যুগেও শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শত শত মাইল পিছিয়ে আছে। রাজনৈতিক এই অপসংস্কৃতির করাল ছোবল থেকে আমাদের জাতীয় শিক্ষাকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
জাতীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি আদর্শ ও স্থায়ী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারলে এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেতিবাচক না হয়ে অবশ্যই ইতিবাচক হবে এবং প্রকৃত শিক্ষা এবং উত্তম রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাবে এদেশের জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। তাই আমাদেরকে জাতীয় স্বার্থ ও আশা-আকাক্সক্ষার কথা ভেবে প্রথমেই দেশের সর্বস্তরে আদর্শ শিক্ষার বিস্তরণ ঘটাতে হবে এবং এর যথার্থ প্রতিফলনের মাধ্যমে একটি দেশপ্রেমিক শক্তিশালী জাতিসত্তা গড়ে তুলতে হবে। আবেগের পরিবর্তে বেগ, যুক্তির পরিবর্তে প্রযুক্তি, মমতার পরিবর্তে ক্ষমতা, মানবিকতার পরিবর্তে পাশবিকতা-এ ধরনের শিক্ষালাভ এবং শিক্ষা বিস্তারের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা, এ ধরনের শিক্ষার পথ ধরেই ধ্বংসের পথে উত্তরোত্তর এগিয়ে চলছে বিশ্বের সকল দেশ ও জাতি। বিশ্বের সর্বত্র শিক্ষাকে সঠিক ও সমুন্নত রাখতে পারলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিসহ সব ধরনের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ইতিবাচক ও গুণগত পরিবর্তন আসবে।
পরিশেষে বলবো, আদর্শ শিক্ষার প্রসার চাই, রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত বিকাশ চাই। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষা ও রাজনীতি- উভয়েরই ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একে অপরের পরিপূরক হয়ে এই দুই তাৎপর্যমণ্ডিত বস্তু একটি দেশকে অল্প শ্রম ও অল্প সময়ে উন্নতি ও সাফল্যের চূড়ান্ত সীমায় উপনীত করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন দেশের সরকার-জনগণ নির্বিশেষে সকলের আন্তরিক সদিচ্ছা, সৎ চেষ্টা, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম এবং অদম্য মনোবল।
(অধ্যক্ষ, মেরন সান কলেজ)

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Your Link | Your Link | Your Link
Copyright © 2013. অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ রচিত প্রবন্ধ ও নিবন্ধ - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Wiki Template
Proudly powered by Wiki Bangla